বিএনপি-জামায়াতসহ ৩২ দলের কাছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন

ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বিএনপি ও জামায়াতসহ মোট ৩২টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন কমিশন এসব প্রতিবেদন দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিটি প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি চিঠিও সংযুক্ত করেছে।
প্রতিটি চিঠিতে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর কাছে সংস্কার সুপারিশগুলো নিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামতের ধরন মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের (এমসিকিউ) আদলে সাজানো হয়েছে, যেখানে ‘একমত’, ‘আংশিক একমত’ এবং ‘ভিন্নমত’-এই তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। এছাড়া সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও সময় নির্ধারণের জন্য পাঁচটি বিকল্প পদ্ধতি প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে—নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে এবং নির্বাচনের পর সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে। আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে লিখিত মতামত চেয়েছে কমিশন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সূত্র জানায়, ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোর মতামত পাওয়ার পর সংলাপ আয়োজন করা হবে। রোজার ঈদের আগেই বিএনপি, জামায়াতসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে এবং জোটবদ্ধ দলগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সংলাপে বসার পরিকল্পনা রয়েছে। বিএনপির মিত্র ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে যৌথ সংলাপ হবে, একইভাবে গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম ও বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অন্যান্য জোটের সঙ্গেও সংলাপ হবে।
এছাড়া নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়াও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। যেমন, নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে সদ্য আত্মপ্রকাশ করা ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)-কেও প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, যদিও দলটি এখনো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাস মেয়াদী জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করে এই কমিশন গঠন করা হয়। এছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রধানরা এতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কমিশন প্রথমবারের মতো ৫৪টি রাজনৈতিক দল-জোটের প্রায় ১০০ নেতার সঙ্গে রাজধানীর হেয়ার রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠক করে। সেই বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা তখনও সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন পাননি। তখনই প্রধান উপদেষ্টা প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেন। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত হয় যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়ার পর কখনো একত্রে, প্রয়োজনে আলাদাভাবে বৈঠক হবে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সংলাপ শেষ হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো ‘জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সনদের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে, বাকিগুলো রাজনৈতিক সরকার বাস্তবায়ন করবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনের আগে সীমিত সংস্কারে সম্মত হয়, তাহলে জাতীয় নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। অন্যথায়, নির্বাচন ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে হবে।
যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকবে, সেগুলোর ভিত্তিতেই ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা হবে। সাংবিধানিক সংশোধন প্রয়োজন এমন বিষয়গুলোতে গণভোট আয়োজনের বিকল্পও রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে সংসদ নির্বাচনের সময়ই গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে।
১২ দলীয় জোটের নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার জানিয়েছেন, গত তিন দিনে তারা পর্যায়ক্রমে ছয়টি প্রতিবেদন পেয়েছেন এবং দলীয়ভাবে পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত মতামত কমিশনে জমা দেবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের বিকল্প নেই। দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ জরুরি, অন্যথায় দেশ আরও সংকটে পড়তে পারে।”
অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, প্রতিটি দলের মতামত কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। কোনো দল যদি একটিও প্রস্তাবে একমত না হয়, তাতেও সমস্যা নেই। তবে কে কোন সুপারিশে একমত বা ভিন্নমত পোষণ করেছে, তা জনসমক্ষে জানানো হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই উদ্যোগ রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনা সৃষ্টি করেছে। সংস্কারের বিষয়টি কিভাবে রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করে এবং এর ভিত্তিতে আগামী দিনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কীভাবে এগোয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
